নিউজ ডেস্কঃ সিলেট-আখাউড়া রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এ সেকশনে রয়েছে ১৩টি মহাঝুঁকিপূর্ণ সেতু, রেলওয়ের ভাষায় যার নাম ‘ডেড স্টপ’। ডেড স্টপ মানেই সেখানে সব ধরনের ট্রেন দাঁড়াবে। ডেড স্টপ ছাড়াও পুরো রেলপথই ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের অর্ধশতাধিক অরক্ষিত রেলক্রসিং পরিণত হয়েছে ভয়াবহ মৃত্যুফাঁদে। এসব অরক্ষিত রেলক্রসিং দিয়ে প্রতিদিনই পারাপার হচ্ছে অসংখ্য পথচারী ও যানবাহন। ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এ রুটে সিলেটের শিববাড়ী, ফেঞ্চুগঞ্জের ইলাশপুর, মাইজগাঁও, ফেঞ্চুগঞ্জ, কুলাউড়া স্কুল চৌমোহনা ও বরমচাল রেলক্রসিংয়ে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানিসহ অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করলেও টনক নড়েনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের।
২০১৫ সালের ৬ মার্চ ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ছত্তিশ গ্রামের যুবক তারা মিয়া মাইজগাঁও রেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে নিহত হন। ১৫ মার্চ দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ী লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে আব্দুল মুকিত নামে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মী মারা যান। ৯ সেপ্টেম্বর ফেঞ্চুগঞ্জ ক্রসিংয়ে ঢাকাগামী আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেনে কাটা পড়েন কটালপুর ডণ্ডি গ্রামের কটন আলী। ২০১৬ সালের ২০ জুন একই ক্রসিংয়ে অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবকের মৃত্যু হয়। ২৪ জুন মিরাজ মুন্সি নামে ফরিদপুর গ্রাসরুট টেক্সটাইল কলেজের ছাত্র মাইজগাঁও রেলক্রসিংয়ে ট্রেনে কাটা পড়েন। ২০১৭ সালের ২০ জুন ফেঞ্চুগঞ্জ রেলক্রসিংয়ে টিটু আচার্য নামে এক শিক্ষকের প্রাণ যায় ট্রেনে কাটা পড়ে। ২০১৮ সালের ৯ মে ফেঞ্চুগঞ্জ রেলব্রিজে নাইম এবং একই দিন হবিগঞ্জের মিরপুরে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি রেললাইন পারাপারের সময় ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে মারা যান। ৪ জুলাই মাইজগাঁও রেলক্রসিংয়ে আয়না বিবি কাটা পড়েন সিলেটগামী জালালাবাদ ট্রেনের নিচে। ১৬ জুলাই ফেঞ্চুগঞ্জ রেলস্টেশন ক্রসিংয়ে সুরমা মেইল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মৃত্যু হয়।
২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর মোমিনছড়া চা বাগানের কাছে রেলক্রসিংয়ে এক অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালে কুলাউড়া থেকে ছেড়ে আসা সিলেটগামী আন্তঃনগর পারাবত এক্সপ্রেস কুলাউড়ার ভাটেরা ইউনিয়নের হোসেনপুর বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমের একটি ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিলে তিনজন নিহত ও আটজন আহত হন। একই বছরের ২ সেপ্টেম্বর মাধবপুরে ট্রেনে কাটা পড়েন এরশাদ মিয়া নামে এক রেল কর্মচারী। ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের অদূরে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান সাদেক, পাবেল ও রুবেল নামে তিন যুবক। ২০২৩ সালের ১২ অক্টোবর শায়েস্তাগঞ্জে সুজন মিয়া এবং সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর ফেঞ্চুগঞ্জের ইলাশপুর পয়েন্টে গেটম্যানের অবহেলায় আন্তঃনগর পারাবত ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় জকিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস শহীদের।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সিলেট অঞ্চল সূত্রে জানা গেছে, সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা তাদের অধীন। এ অঞ্চলে অনুমোদনহীন রেলক্রসিং রয়েছে ৫৬টি। এ তিন জেলায় অনুমোদিত রেলক্রসিং ১৯টি। এর মধ্যে সাতটিতে গেটম্যান থাকলেও বাকি ১২টি লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার ইলাশপুর ও মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় কুলাউড়া-বড়লেখা রেলক্রসিংয়ে ছয়জন গেটম্যান দায়িত্ব পালন করছে। সচেতন মহল ও সংশ্লিষ্টদের মতে, আইন অমান্য করে রেললাইনে চলাফেরা, লেভেল ক্রসিং ও রেলসেতু পারাপার এবং গেটম্যান ছাড়া লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। আখাউড়া রেলওয়ে থানার ওসি মাজহারুল করিম জানান, সমস্যাগুলো সমাধানে সীমিত জনবল ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়েও তারা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সিলেট আখাউড়া রেল রুটে অর্ধশতাধিক অবৈধ রেলক্রসিং গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ৩০টিরও বেশি। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিংগুলোর মধ্যে শিববাড়ী, ফেঞ্চুগঞ্জ রেলস্টেশন রেলক্রসিং, ফেঞ্চুগঞ্জ কুলাউড়া সড়কের বরমচাল রেলক্রসিং, ব্রাহ্মণবাজার-শমসেরনগর সড়কের রেলক্রসিং অন্যতম। এসব ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিংয়ে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটলেও সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সিলেট অঞ্চলের প্রকৌশলী আশরাফুল আলম খান গনমাধ্যমকে জানান, অবৈধ ক্রসিংগুলো বন্ধে ২০০৯ সালে মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করা হয়। রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় প্রকৌশলী-২-এর পক্ষ থেকে দেশের সবক’টি অবৈধ রেলক্রসিং বাতিল করতে রেল মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরবর্তী সময়ে রেল সচিবালয় থেকে জেলা প্রশাসকের কাছে নির্দেশ আসে নিরাপত্তার স্বার্থে অবৈধ রেলক্রসিংগুলোতে স্থানীয়ভাবে গেটম্যান নিয়োগের। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নিতে অনীহা প্রকাশ করায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।