মাহফুজ শাকিল: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বিভিন্ন এলাকায় নীতিমালার তোয়াক্কা না করে শত শত একর কৃষি জমির উর্বর মাটি এস্কেভেটর মেশিন (খননকারী যন্ত্র) দিয়ে কেটে নিয়ে যাচ্ছেন ইটভাটা মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এসব মাটি মানুষের বাসা-বাড়িতেও ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে জমি হারাচ্ছে তার উর্বরতা। এতে ফসলি জমির উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয় ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে পরিবেশ। পাশাপাশি মাটি পরিবহন ট্রাক, ট্যাক্টর, ট্রলি যত্রযত্রভাবে মাটি ভর্তি করে সড়ক ও ইউপির পাকা রাস্তাগুলোতে চলাচল করায় মাটি পড়ে সড়ক নষ্ট হচ্ছে। এতে সামান্য বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হলেই পাকা ও কাঁচা রাস্তায় বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়। এদিকে উপজেলার রাউৎগাঁও ও কাদিপুর ইউনিয়নের মধ্যবর্তী কাপুয়া ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় মাটি বোঝাই ট্র্যাক চলাচলের সুবিধার্থে ফানাই নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে আগামীতে খাদ্য ঘাটতিসহ পরিবেশ বিপর্যয় ও কৃষি জমি হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন সচেতনরা।
জানা গেছে, কুলাউড়ায় উপজেলায় ১৩ টি ইটভাটা রয়েছে। প্রতিবছর ৬ মাস ইটভাটায় ইট উৎপাদন হয়। ওই ৬ মাসে একেকটি ইটভাটায় প্রায় ৭০-৮০ লাখ ইট প্রস্তুত করা হয়। ইট তৈরির একমাত্র কাঁচামাল এঁটেল ও দোআঁশ মাটি। কাঁচামালের যোগান দিতে ফসলি জমির মাটি বেচাকেনার কাজে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছেন। তারা বছরের বিভিন্ন সময় (অফ-সিজন) কম দামে একর বা বিঘা চুক্তিতে কৃষকের জমির মাটি কিনে রাখেন। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটার জন্য ফসলি জমি থেকে মাটি কেটে তা বেশি দামে ইটভাটায় সরবরাহ করেন। মাটি বিক্রি করায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটিতে যে জিপসাম বা দস্তা থাকে তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি যে জমি থেকে গভীর করে মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে সেই জমির কারণে পাশের জমিও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে করে দিন দিন কৃষি জমিতে উৎপাদন ক্ষমতা ক্রমশই কমছে। মাটির জৈব শক্তি কমে গিয়ে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতির মুখে পড়বে। আর এভাবে ফসলি জমির মাটি ইট ভাটায় যেতে থাকলে ধীরে ধীরে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে বলে মনে করছেন উপজেলা কৃষি বিভাগ।
সরেজমিন কুলাউড়ার দক্ষিণ চাতলগাঁও, কাদিপুর, কৌলা, হোসেনপুর, গুপ্তগ্রাম, ঢুলিপাড়া, হিংগাজিয়া, লালপুর, বাঘেরটেকি, কটারকোনা, পলকির পুল, ভূকশিমইল, শরীফপুর, রাউৎগাঁও, কুলাউড়া সদর, কর্মধা, পৃথিমপাশা, টিলাগাঁও, হাজীপুর, জয়চন্ডী, ভাটেরা, ব্রাহ্মণবাজার, বরমচালসহ প্রায় অর্ধশত স্থানে গিয়ে দেখা যায়- খননকারী যন্ত্র দিয়ে কৃষি জমির দুই-তিন ফুট পর্যন্ত গভীর করে মাটি ট্র্যাক ভর্তি করে ইটভাটা ও বাসা বাড়িতে নেওয়া হচ্ছে। কিছু কৃষক নগদ টাকা পাওয়ার আশায় কৃষিজমির এসব উর্বর মাটি বিক্রি করছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি শফি আলম ইউনুসের জোনাকী ব্রিকস, সাধারণ সম্পাদক ফয়েজ উদ্দিনের সুরমা ব্রিকস, লন্ডন প্রবাসী কামরুন নাহারের কেএসবি ব্রিকস, সাহাব উদ্দিনের মেঘনা ব্রিকস, সারওয়ার আহমদের রুপসী ব্রিকস, আব্বাছ আলীর কলিম উল্লাহ ব্রিকস, সেলিম আহমদ চৌধুরীর উস্তয়ার ব্রিকস, দেলোয়ার হোসেন বাচ্চুর এএসবি ব্রিকস, আমীর আলীর আরব ব্রিকস, আলী নকি খাঁনের রাজ ব্রিকস, ফজলুর রহমানের বাড়ুয়াকান্দি ব্রিকস, মাজিদুর রহমান আফজলের তিতাস ব্রিকসে অবাধে কৃষি জমির মাটি যাচ্ছে।
দক্ষিণ চাতলগাঁও এলাকার বাসিন্দা কৃষি জমির মালিক কয়েছ আহমদ বলেন, জোনাকী ও সুরমা ব্রিকসের মালিকরা আমাদের কাছ থেকে হাজার প্রতি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দরে মাটি ক্রয় করে নিচ্ছেন। তবে আমি আমার জমি বেশি গভীর করে মাটি দিচ্ছি না। ফসলি জমির ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাময়িক ক্ষতি হলেও দুই-তিন বছর পর জমি পুনরায় আগের অবস্থানে ফিরে আসবে।
একই এলাকার আরেক কৃষি জমির মালিক সোয়েব আহমদ বলেন, আমি দীর্ঘদিন যাবৎ মাটি বিক্রি করিনি। কিন্তু আমার পাশের জমির মালিকেরা মাটি বিক্রি করায় আমার জমি অনেক উঁচু রয়ে যায়। উঁচু জমিতে পানি না থাকায় ধানের ফলন তেমন ভালো হয়না। তাই এবার বাধ্য হয়ে জমির সমতা ফিরিয়ে আনতে আমার দেড় কিয়ার জমির কিছু মাটি বিক্রি করেছি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতা মিনহাজ উদ্দিন কমরু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সড়ক দিয়ে যত্রতত্র মাটি পরিবহনের কারণে মোটরযান আরোহীদের মরন ফাঁদে পরিণত হয়েছে কুলাউড়া-মৌলভীবাজার সড়কের ঢুলিপাড়া-কৌলা এলাকাটি। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা পিচ্ছিল হয়ে অনেককেই দূর্ঘটনার শিকার হতে হয়। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। কুলাউড়া ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও সুরমা ব্রিকসের মালিক ফয়েজ উদ্দিন বলেন, হাতেগোনা কয়েকজন সরাসরি জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করলেও সিংহভাগ ভাটা মালিকেরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাটি ক্রয় করেন। কৃষি জমির উর্বর মাটি কেটে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে অনেক কৃষক অভাবে পড়ে মাটি দেয়ার কথা বলে আমাদের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা নেন। আবার কয়েক বছর জমিতে প্রয়োজনীয় গোবর ও সার দিয়ে জমির সক্ষমতা ফিরিয়ে আনেন কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মোমিন বলেন, কৃষি জমির উপরিভাগের ১৫ ইঞ্চি মাটি বেশ উর্বর হয়, কিন্তু তা বিক্রির ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়, কমে যায় ফসল উৎপাদন ক্ষমতা। আমরা কৃষকদের এভাবে জমির মাটি বিক্রি না করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহমুদুর রহমান খোন্দকার বলেন, বর্তমান সময়ে স্থানীয় লোকজন তাদের জমির মাটি দিয়ে ইটভাটা ও বাসাবাড়ির ভিটে ভরাটের প্রবণতায় থাকেন। কিছু ইটভাটা মালিকদেরও সেই প্রবণতা থাকে। যেখানে মাটির টপ সয়েল কাটা হচ্ছে আমরা সরেজমিন গিয়ে সেখানকার খোঁজখবর নিচ্ছি। শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, কৃষি জমির উর্বর মাটি কাটা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। ইতোমধ্যে মাটি বিক্রির সাথে জড়িত ব্যবসায়ী ও ইটভাটা মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে। কুলাউড়ায় অবাধে মাটি কাটার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া ফসলি জমি থেকে মাটি বিক্রি না করার জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রদক্ষেপ নেয়া হবে।