নিউজ ডেস্কঃ প্রতিদিন রাতে বৃষ্টি হয়, পাহাড়ী ঢলে একদিনেই তলিয়ে যেতে পারে পুরো হাওরের বোরো ধান। এমন উদ্বেগ উৎকন্ঠার সাথে রোযা ও করোনা। এই অবস্থায় কৃষকরা কষ্টের ফসল মাঠে ফেলে রাখতে চান না। হাওরের পাকা ধান গোলায় তোলতে মরিয়া হয়েছেন তারা। এমন প্রতিকুলতাকে মোকাবেলা করেই এশিয়ার বুহত্তম হাওর হাকালুকি পাড়ে চলছে উৎসবমূখর পরিবেশে বোরা ধান কাটা। তবে ধান কাটা শ্রমিকের সঙ্কটের পাশাপাশি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেশি হওয়ায় হতাশ কৃষকরা।
সরেজমিন হাকালুকি হাওরের ধলিয়া বিল ও গৌড়কুড়ি বিল কুলাউড়া উপজেলা অংশ ভুকশিমইল ইউনিয়নের সাদিপুর, মীরশঙ্কর, গৌড়করণ, মহেষগৌরি, মদনগেীরি এলাকায় গেলে, ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান শুকানোসহ বোরো ধান নিয়ে কুষকদের ব্যস্ত সময় পার থেকে দেখা যায়। রমযান মাস হওয়ায় কৃষক নিজে ধান কাটতে পারলে সেই ধান জমি থেকে মাড়াই করার স্থানে আনতে শ্রমিক ব্যবহার করতে হয়। পুরুষের সঙ্গে সমানতালে মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন নারী ও শিশুরা। পুরুষরা ধান কাটছেন এবং পাশের খালি জায়গায় রাখছেন। একদল পুরুষ ধান মেশিনে মাড়াই করছেন। আর পুরুষের পাশাপাশি নারীরা এই ধানগুলো খলায় নিয়ে শুকানোর কাজ করছেন। পরে এই ধানগুলো ঠেলা ও ট্যাক্টরযোগে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন একদল কৃষক।
সাদিপুর গ্রামের কৃষক ফারুক মিয়া (৭০) জানান, ৮ কিয়ার (বিঘা) জমিতে বোরো ধান রোপন করেছেন। রোযার কারণে ও বয়সের ভারে তিনি নিজে ধান কাটতে পারছেন না। ৫ জন ধান কাটার শ্রমিক লাগিয়েছেন। খাবারসহ প্রতিদিন ৫০০ টাকা হারে দিতে হচ্ছে। ফলে ৫ শ্রমিকে প্রতিদিন খাবারসহ খরচ কমপক্ষে ৩ হাজার টাকা। তারা ২ দিনে একবিঘা জমির ধান কাটলে বিঘা প্রতি খরচ হচ্ছে ৬ হাজার টাকা। এরপর ধান মাড়াইসহ অন্যান্য খরচ। এই ধানের উপর নির্ভরশীল তাদের ৬ জনের পরিবার। এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হলেও প্রতি মন ধানে খরচ প্রায় হাজার টাকা। অথচ হাওরে ধান বিক্রি করলে প্রতি মন ধান ৪ থেকে ৫শত টাকার বেশি বিক্রি করা সম্ভব নয়।
হাকালুকি হাওর তীরের কুরবানপুর গ্রামের আছদ আলী ২ বিঘা জমিতে, গৌড়করন গ্রামের কৃষক আব্দুর রউফ প্রায় ২ একর জমিতে, মহেষগৌরি গ্রামের আব্দুস সামাদ ৭ একর, শামীম মিয়া ২ বিঘা জমিতে, সাদিপুর গ্রামের সালাউদ্দিন ২২ বিঘা জমিতে, জমসেদ আলী ১২ বিঘা, আব্দুস সালাম ৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। তারা প্রত্যেকেই জানান, এবার তারা বিআর-১৪, ব্রি-৫৮, ব্রি-২৯, ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপন করেছেন। এবার চৈত্র মাস থেকে বৃষ্টিপাত হওয়ায় বোরো ধানের ভালো ফলন হয়েছে। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ থেকে ধান কাটা শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ ভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। তবে ধান শ্রমিক খরচ বেশি হওয়ায় তারাও হতাশ। পহেলা বৈশাখ থেকে প্রায় প্রতিদিন রাতে ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে।
কৃষক সাদিক মিয়া বলেন, প্রায় প্রতি রাতেই বৃষ্টি হচ্ছে। বোরো ধান যেন আরও পোক্ত হয় সেজন্য অপেক্ষা করছেন অনেকে। কিন্তু বৃষ্টি দেখে ভয় হয়। তবে কৃষি বিভাগের মাইকিং এর কারণে অনেকেই বোরো ধান কাটতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
অনেক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, হাওরের ভিতরে কয়েকটি ছড়া-খালে পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। শুষ্ক মৌসমে পানির ব্যবস্থা থাকলে আমাদের চাষাবাদে অনেক সুবিধা হতো। তাছাড়া সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছিনা। গুঙ্গিজুড়ী খাল খনন কমিটির উপদেষ্ঠা কুরবানপুর গ্রামের কৃষক আছদ আলী বলেন, হাকালুকি হাওরের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে গুঙ্গীজুড়ী খালটি। সেটি জুড়ী নদীর সাথে সংযুক্ত হয়েছে। এই খালের দুরত্ব প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার। এই খালটি সরকারিভাবে কখনো খনন করা হয়নি। যারফলে স্থানীয় মহেষগৌরি ও গৌড়করণ এলাকার মানুষের উদ্যোগে দুই লক্ষ টাকা ব্যয়ে খালের মধ্যখানে ১৮০০ ফুট খনন কাজ করা হয়। যার সুবিধা পাচ্ছে গৌড়করণ, মদনগৌরি, মহেষগৌরি, কুরবানপুর ও শাহপুর এলাকার শত শত কৃষকরা। এই খাল সরকারি খরচে স্থায়ীভাবে যদি খনন করা হয় তাহলে হাকালুকি হাওরের শত শত কৃষকের বোরো আবাধ করতে কোন দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, কুলাউড়া উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট ৭ হাজার ৯১২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। এবার বিআর-১৪, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯, ব্রি-৫৫, ব্রি-৫৮, ব্রি-৬৩, ব্রি-৬৪, ব্রি-৬৭, ব্রি-৬৮, ব্রি-৬৯, ব্রি-৭৪, ব্রি-৭৯, ব্রি-৮১, ব্রি-৮৪, ব্রি-৮৮, ব্রি-৯২, সহ মোট ১৭ জাতের ধান রোপন করেছেন কৃষকরা। এছাড়াও ৫ জাতের হাইব্রীড এসএলএইচএইচ, ময়না, টিয়া, হিরা-২, রুপালী বোরো ধান চাষ করেছেন কৃষকরা। সবচেয়ে বেশি বিআর-১৪, ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ ধানের বেশি ফলন হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল মোমিন বলেন, কুলাউড়ায় এবার ৭ হাজার ৯১২ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। গতবছর এ উপজেলায় ৬ হাজার ৯শ’ ২০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। রমজান মাস থাকায় বোরো ধান কাটতে শ্রমিক সংকট যাতে না হয় তারজন্য চা বাগানের শ্রমিকদের প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কৃষিবিভাগ কৃষকদের ধান কাটা শ্রমিক দেয়ার পাশাপাশি ধান কাটা ও মাড়াই দিতে কৃষকদের ২টি (কম্বাইন্ড হারবেস্টার) মেশিন দেয়া হয়েছে। হাতে রয়েছে আরো ৪টি মেশিন। কোন কৃষক আগ্রহী হলে মেশিনগুলো দেয়া হবে। একেকটি মেশিন ঘন্টায় এক একর জমির ধান কাটতে পারে। ফলে কৃষকরা কম খরচে ও তুলনামূলক কম সময়ে বেশি ধান কাটতে পারবে। তিনি আরো জানান, ঝড়-বৃষ্টির কারণে উপজেলায় ক্ষেতের বোরো ধানের ক্ষতি হতে পারে। তাই প্রাকৃতিক দূর্যোগে পুরো ফসল যেন নষ্ট না হয়, সেজন্য মাইকিং চলছে। আমরা প্রতিদিন মাইকিং এর জন্য শিডিউল করে দিয়েছি। বোরো চাষিদের দ্রুত ধান কেটে ঘরে তোলার জন্য আগাম সতর্কতা জারি করা হয়েছে।